ব্যাংকিং খাতে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়িয়েছে। অপরদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অতিরিক্ত শেয়ার ধারণ করছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা। এতে করে ব্যাংকটির মালিকানা নিয়ে জটিলতা দিন দিন বাড়ছে।
জানা যায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনে একজন পরিচালক ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারেন না। কিন্তু ডাচ-বাংলার অভিযুক্ত উদ্যোক্তারা এ আইনকে তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত শেয়ার ধারণ করছেন বলে প্রমাণ মিলেছে।
সম্প্রতি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক আব্দুস সালামের নামে থাকা শেয়ারের মালিকানা দাবি করে আরেকজন আদালতে গিয়েছেন। তবে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা হারানো এবং সুনামের হানি হবে জেনে বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে মীমাংসার চেষ্টা করেও তা পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবেদুর রশিদ খান নিম্ন আদালতে মামলা করেছেন।
জানা গেছে, এ ব্যাংকের উদ্যোক্তা আব্দুস সালামের নামে প্রায় ১৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কিন্তু বিধি মোতাবেক একজন উদ্যোক্তা এই পরিমাণ শেয়ার নিজের নামে রাখতে পারেন না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিনি বেআইনিভাবে ওই পরিমাণ শেয়ার ধারণ করছেন।
ব্যাংকের উদ্যোক্তা আবেদুর রশিদ খান, আব্দুস সালাম এবং শাহাবুদ্দিন এই তিনজন মিলে নিজেদের স্বার্থে কৌশলে এটি করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
মামলায় বলা হয়, আবেদুর রশিদ খান ১৯৯৫ থেকে ৯৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আব্দুস সালামকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করার জন্য মোট ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দেন। মামলায় এসব শেয়ারের ট্রাস্টি বলা হয় আব্দুস সালামকে। এতে মধ্যস্থতা করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে মোট ৩ কোটি ৪৮ লাখ ২২ হাজার ২৯০টি শেয়ার রয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা। কিন্তু আমানত হিসেবে রাখা এসব শেয়ারের মালিকানা দাবি করছেন আবদুস সালাম। তিনি এ শেয়ারের একটি অংশ বিক্রির মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলার আর্জিতে আবদুস সালামের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ার লেনদেনে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘‘আইনগতভাবে কারও কাছে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার কথা নয়। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের দু’ একজন উদ্যোক্তার কাছে পরিমাণের চেয়ে বেশি শেয়ার রাখার কথা সত্য। তবে কোম্পানি আইনে এটি কোনো ব্যাংক করতে পারে না। কিন্তু তারা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি আদেশ আমাদের দিয়েছে।’’
একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি আদালত বিষয়টি বেআইনি বলে তবে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
আরও জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে কোনো উদ্যোক্তা বা তার মালিকানার প্রতিষ্ঠান অথবা পরিবারের সদস্য সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারেন। অথচ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উদ্যোক্তারা এ আইন ভঙ্গ করেছেন। জেনে শুনে প্রকাশ্যেই তারা এমনটি করে যাচ্ছেন। অপরদিকে ব্যাংকটির এই বেআইনি কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নীরব সমর্থন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
তবে এ দফায় আদালতের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা নিতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ছাড়া বর্তমানে আর কোনো ব্যাংকে আইনের এতবড় গড়মিল নেই। আর কোনো ব্যাংক হলে মেনে নেওয়াও হতো না।
তবে আরেকটি ঊর্ধ্বতন সূত্র বাংলানিউজকে জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ে যায় ডাচ- বাংলা ব্যাংক। তারা সেখানে ক্ষমতা দেখিয়ে নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখে একটি আদেশ বের করে। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অপেশাদারমূলক হয়েছে।
জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে পাইওনিয়ার হ্যাচারি লিমিটেডের নামে সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (সাবিনকো) থেকে নেওয়া ঋণের অর্থে আবদুস সালামের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শেয়ার কেনেন আবেদুর রশিদ খান।
মামলার এজাহারে আবেদুর রশিদ উল্লেখ করেন, হ্যাচারি প্রকল্পে ঝুঁকি থাকায় দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা ছিল। প্রকল্পটিতে লোকসান হলে নিজের নামে থাকা সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হতে পারে এমন আশঙ্কায় নিজ নামে সব অর্থ বিনিয়োগ করতে চাননি আবেদুর রশিদ। এ কারণেই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিনিয়োগ সুরক্ষার কথা ভেবে সালামের নামে ডাচ্-বাংলার শেয়ার কেনেন।
তবে পাইওনিয়ার হ্যাচারির নামে সাবিনকো থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে মোট ৯০ লাখ টাকার। বিপরীতে সালামের নামে শেয়ার কেনা হয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকার।
এ ব্যাপারে আবেদুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। কিন্ত তার আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন।